নিউজ ডেস্ক
প্রযুক্তি ক্ষেত্রে অনেকদূর এগিয়েছে বাংলাদেশ। ডিজিটাল থেকে এখন ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গড়ে তোলার জন্য কাজ চলছে। কিন্তু স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলার জন্য ব্যবহৃত প্রযুক্তি ইলেকট্রনিক পণ্যের বর্জ্য (ই-বর্জ্য) তৈরি হচ্ছে একই সঙ্গে। ই-বর্জ্যের এক-তৃতীয়াংশ সৃষ্টি হচ্ছে মুঠোফোন থেকে। তবে পুরোনো ও নষ্ট মোবাইল ফোন সেট, কম্পিউটার, ল্যাপটপ, অকেজো ও অব্যবহৃত ইলেকট্রনিকস যন্ত্রপাতি ফেলে দেওয়ার যোগ্য হলেও তা মোটেও ফেলনা নয়। এসব ই-বর্জ্যের মধ্যেই লুকিয়ে আছে তামা, দস্তা, রুপা, স্বর্ণ, প্লাটিনাম বা প্যালাডিয়ামের মতো মূল্যবান ধাতু।
এমনকি এসব ই-বর্জ্য থেকে পাওয়া প্লাস্টিকও বেশ দামে বিক্রি হচ্ছে। বাজার সূত্র বলছে, দেশে মাসে শতকোটি টাকার ই-বর্জ্য থেকে পাওয়া উপাদানগুলো বেচাকেনা হয়, বছরে যার পরিমাণ ১ হাজার ২০০ কোটি টাকার বেশি। ই-বর্জ্য সংগ্রহ প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শুরু হলেও মোবাইল ফোন বা ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহারকারীদের মাঝে সাড়া কম। কোনও কিছু নষ্ট হয়ে গেলে বা মেরামত উপযোগী না থাকলে, তা কোথায় ফেলতে হবে সেটা বেশিরভাগেরই জানা নেই। ফলে এসবের ঠাঁই হয় ঘরের কোণে, খাটের নিচে, ফলস ছাদে বা চিলেকোঠায়। এভাবে জমতে জমতে তার বিস্তার বাড়ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্যক্তিগত ব্যবহারকারীরা এখনও সচেতন নন। এতে ক্ষতি হচ্ছে পরিবেশের, এমনকি বাসার ছোট্ট শিশুটিরও। কারণ, শিশুরা না জেনেই এসব মুখে তুলে নেয়। ব্যবহারকারীরা সচেতন হলে ই-বর্জ্যের স্তূপ হবে না।
আর এ কারণেই যারা এসবের রিসাইক্লিংয়ের সঙ্গে জড়িত তারা বলছেন, ব্যক্তি পর্যায় থেকে এখনও ই-বর্জ্য সংগ্রহে সাড়া কম। যা হচ্ছে তার বেশিরভাগই কর্পোরেট পর্যায় থেকে। এছাড়া অন্যান্য আরও যেভাবে ই-বর্জ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে তার পরিমাণ খুবই কম। ই-বর্জ্যের মধ্যে রয়েছে মেয়াদোত্তীর্ণ বা নষ্ট হয়ে যাওয়া মোবাইলফোন, কম্পিউটার, প্রিন্টার, টেলিভিশন, এয়ারকন্ডিশনার, বৈদ্যুতিক বাতি, বিভিন্ন ধরনের ইলেকট্রনিক ইত্যাদি। এসবে রয়েছে সিসা, পারদ, লিড অক্সাইড, ক্যাডমিয়াম জাতীয় ধাতব ও রাসায়নিক উপাদান। সূত্র বলছে, আগামী ২০৩০ সাল নাগাদ বিশ্বে ই-বর্জ্যের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়াবে ৭ কোটি ৪৭ লাখ মেট্রিক টনে। মুক্তবাজার অর্থনীতিতে নগরায়ণে বাড়ছে ই-পণ্যের চাহিদা। এ ক্ষেত্রে ডিজিটাল থেকে স্মার্ট পথে যাত্রা করা বাংলাদেশেও এসব পণ্যের চাহিদা ব্যাপক।
আর স্বাস্থ্য ও পরিবেশগত ঝুঁকি নিয়েই উন্নত দেশের ব্যবহৃত তথ্যপ্রযুক্তি ও ইলেকট্রনিকস পণ্যের অবাধ আমদানি এবং তা যথাযথ প্রক্রিয়ায় ডাম্পিং না করায় ই-বর্জ্যের ভাগাড়ে পরিণত হচ্ছে বাংলাদেশ। প্রতিবছর দেশে সৃষ্টি হচ্ছে ৩০ লাখ মেট্রিক টন ই-বর্জ্য। এর মধ্যে কেবল মুঠোফোন থেকেই সৃষ্টি হচ্ছে সর্বোচ্চ সাড়ে ১০ লাখ টন ই-বর্জ্য। অন্তত ২ লাখ ৯৬ হাজার ৩০২টি নষ্ট টেলিভিশন থেকে সৃষ্টি হচ্ছে ১ লাখ ৭০ হাজার টনের মতো ই-বর্জ্য। আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে, বছর ঘুরতে না ঘুরতেই এই বর্জ্যের পরিমাণ বেড়েছে ৩০ শতাংশ। সেই হিসাবে ২০২৫ সাল নাগাদ কোটি টনের ই-বর্জ্যের ভাগাড়ে পরিণত হবে বাংলাদেশ।
কেননা, ২০৩০ সাল নাগাদ বছরে ১০০ কোটি মুঠোফোন উৎপাদন হবে এবং কম্পিউটারের পিসিবিভিত্তিক ধাতু পুনরুদ্ধার ব্যবসা সম্প্রসারিত হবে, যা ডেকে আনতে পারে ভয়াবহ মানবিক সংকট। অনাহূত এই মানবিক সংকট মোকাবিলায় সচেতনতা তৈরির পাশাপাশি ‘ই-বর্জ্য’ সৃষ্টিকারী রিফারবিশড (পুরোনো বা ফেলে দেওয়া পণ্য আবার ব্যবহার উপযোগী করা) পণ্যের অবৈধ আমদানি বন্ধ করার উদ্যোগ নেওয়া না হলে ই-বর্জ্য ব্যক্তির স্বাস্থ্য ঝুঁকির পাশাপাশি পরিবেশের ওপরও বিরূপ প্রতিক্রিয়া ফেলবে। যথাযথ ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনা না থাকায় দূষিত করছে পানি, বায়ু ও মাটি। বাড়াচ্ছে পরিবেশের তাপমাত্রা এবং বিনষ্ট করছে জমির উর্বরতাও।
বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, এখনই দেশের ‘ই-বর্জ্য’ নিয়ন্ত্রণ না করতে পারলে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে স্মার্ট বাংলাদেশ। এদিকে ই-বর্জ্য রিসাইক্লিংয়ের সঙ্গে জড়িতরা বলছেন, দেশে প্রতি বছর যে পরিমাণ মোবাইল ফোন নষ্ট হয়, তার ২০ ভাগও আমরা রি-সাইক্লিংয়ের জন্য পাওয়া যায় না। ব্যবহারকারীরা হয় তা মেরামতের পর ব্যবহার করেন, নয়তো ঘরে ফেলে রাখেন। ফলে যে পরিমাণ ই-বর্জ্য তৈরি হয়, তার পুরোপুরি প্রতিষ্ঠানগুলো পায় না। সংশ্লিষ্টরা জানান, ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় একটি মোবাইল বা অন্যান্য ডিভাইস প্রথমেই আলাদা করে ফেলা হয়।
তারপর তা থেকে প্লাস্টিক, মেটাল (ধাতব পদার্থ), আইসি আলাদা করে ফেলা হয়। প্লাস্টিক পৃথক করার পর চিপস তৈরি করে তা ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করা হয়। আর মেটাল পৃথক করে তামা, দস্তা, রুপা পাওয়া যায়। স্বর্ণ, প্লাটিনাম, প্যালাডিয়াম, রোডিয়ামের মতো মূল্যবান ধাতুও পাওয়া যায়। মূল্যবান ধাতু নির্ভর করে গ্রেডভিত্তিক সার্কিট বোর্ডের ওপর। এসব কারণে এই বাজারটা মোটেও ফেলনা নয়। বরং ফেলনা কুড়িয়ে কোটি কোটি টাকা আয় করা সম্ভব। বাংলাদেশ মোবাইল ফোন ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএমপিআইএ)-এর যুগ্ম সম্পাদক মোহাম্মদ মেসবাহ উদ্দিন জানান, প্রতি বছর দেশে গড়ে সাড়ে ৩ কোটি মোবাইল ফোন বিক্রি হয়।
একটি মোবাইল ফোনের লাইফ সাইকেল ৩-৪ বছর। ফলে দেশে প্রতি বছর ৩ কোটির মতো মোবাইল সেট ই-বর্জ্যে পরিণত হচ্ছে। এদিকে দেশে বেশ কিছু ই-বর্জ্য রি-সাইক্লিং প্রতিষ্ঠান রয়েছে। তারা কম্পিউটারের মাদার বোর্ড, টেলিভিশনের সার্কিট বোর্ড, ব্যাটারি, রেফ্রিজারেটরের যন্ত্রাংশ ইত্যাদি ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও রিসাইক্লিং করছে। তবে যে পরিমাণ বর্জ্য উৎপাদিত হচ্ছে সে তুলনায় এই প্রতিষ্ঠানগুলোর সংখ্যা খুবই নগণ। পরিবেশবাদীরা বলছেন, ই-বর্জ্য নিয়ে ভাবা হচ্ছে না। ব্যবহারের পর যেখানে- সেখানে ই-বর্জ্য ফেলা হচ্ছে। এটি কত ভয়াবহ তা-ও অনেকে জানেন না। মানুষের মধ্যে ই-বর্জ্য নিয়ে কোনো সচেতনা নেই। ই-বর্জ্য নিয়ে সচেতনতা বাড়াতে হবে। পুনঃপ্রক্রিয়া (রিসাইক্লিং) করে এসব ই-বর্জ্য অন্যভাবে ব্যবহার করতে হবে।