শাহিনুর রহমান সোনা,রাজশাহী
দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, "এক ইঞ্চি জমিও অনাবাদী রাখা উচিত নয় বরং আমরা যে যা পারি তা উৎপাদন করতে হবে।' আবার রাজশাহী-৩ (পবা-মোহনপুর) আসনে নির্বাচিত সংসদ সদস্য মোহা.আসাদুজ্জামান আসাদ জেলা আওয়ামীলীগের বর্ধিত সভায় কৃষি জমি রক্ষায় ফসলি জমিতে পুকুর খনন বন্ধে কঠোর হুঁশিয়ারী দিয়েছেন। তিনি বলেছেন অনাবাদি,অকেজো, পতিত জমিতে যদি কেউ পুকুর খনন করতে চায় তাহলে যথাযথ কর্তৃপক্ষের নিকট আবেদন করে অনুমতি নিয়ে পুকুর খনন করতে পারবেন।
একবছর আগে ২০২৩ সালে রাজশাহীর মোহনপুর উপজেলার ধুরইল ইউপির বিল পালশা মৌজায় গত ত্রিশ বছর ধরে পড়ে থাকা অনাবাদি অকেজো জমির মালিকদের অনুরোধে জমির সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে ধুরইল ইউপি ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি লিটন আলী ওরফে লিখন কচুরিপানায় পরিপূর্ণ জমিতে পুকুর খনন শুরু করেন। লিটন আলী ওরফে লিখনের আবেদনের প্রেক্ষিতে তৎকালীন সহকারী কমিশনার ভূমি প্রিয়াঙ্কা দাশ জমিটি সরেজমিনে তদন্ত করতে গিয়ে দেখেন জমিতে পুকুর খনন ছাড়া কোনভাবে জমির সদব্যবহার করা সম্ভব নয়। এসময় জমির মালিকরা সহকারী কমিশনার ভূমির কাছে পুকুর খননের জন্য অনুরোধ করলে তিনি সেখান থেকে চলে আসেন। পরবর্তীতে সেখানে পুকুর খনন করে গত এক বছর ধরে মাছ চাষ করে আসছেন লিখন। মাছ চাষ করতে গিয়ে পুকুরের চারপাশের পাড় ভেঙে অন্যের জমিতে চলে যায় এবং দুই পুকুরের মাঝখানে পানি নিষ্কাশনের জন্য যে দাড়া রাখা ছিল সেটিও বন্ধ হয়ে যায়। সামনে ব্যুরো ধানের মৌসুম শুরু হচ্ছে, সেকারণে এই বিলের কৃষকরা অবাধ পানি প্রবাহ ঠিক রাখতে এবং অন্য কৃষকের জমির উপরে উপচে পড়া পুকুরের মাটি অপসারণে লিখনকে অনুরোধ জানায়। কৃষকদের অনুরোধে লিখন উপরোক্ত কাজসহ একবছর আগে খননকৃত পুকুরটির পাড় সংস্কারের অনুমতি নিতে রাজশাহী জেলা প্রশাসক বরাবর আবেদন করলে মোহনপুর সহকারী কমিশনার ভূমি মিথিলা দাস জায়গাটি সরেজমিনে তদন্ত করেন। কাজ করার অনুমতি পাওয়ার আগে কৃষকদের অনুরোধে পানি নিষ্কাশনের জন্য দাড়াটি সংস্কার করতে ১৮ জানুয়ারি (বৃহস্পতিবার) একটি এস্কেভেটর বা ভেকু মেশিন দিয়ে দাড়া সংস্কারের কাজ শুরু করেন।
গত ২১ জানুয়ারি (রবিবার) উপজেলা সদর বাকশিমইল গ্রামের মৃত ছদেরের ছেলে চাঁদাবাজ সেলিম (৪৪) ও পোল্লাকুড়ি গ্রামের আনোয়ার হোসেনের ছেলে পকেটমার মোঃ সোহেল রানার (২৮) নেতৃত্বে চান্দোপাড়া গ্রামের মৃত জয়নাল আবেদিন প্রামানিকের ছেলে নাজমুল হোসাইন প্রামানিক (৪০)সহ একই এলকার আরো ৩/৪ জন বিল পালশা বিলে গিয়ে অন্যায় অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ করে ভেকু চালককে দাড়া সংস্কার কাজ বন্ধ করে দেয় এবং ভেকু মেশিনের চাবি কেড়ে নেয়। এসময় তারা সংস্কার কাজের সরকারি কোন অনুমতি আছে কিনা তার কাগজপত্র দেখতে চায়। পরবর্তীতে কাজ করতে হলে শ্রমিকলীগের সাধারণ সম্পাদক মিলন মাস্টারের সাথে দেখা করে হিসেব নিকেষ করে যেন কাজ করা হয় বলে ভেকু ড্রাইভারকে হুমকি ধামকি দিয়ে নগদ দুই হাজার টাকা নিয়ে ভেকুর চাবি ফেরত দেয়। এরপর আবারো তারা গত ২৭ জানুয়ারি (শনিবার) বিকেলে বিল পালশা বিলে গিয়ে ভেকু ড্রাইভার নাজমুলকে সংস্কার কাজ বন্ধ করতে বলে এবং তাকে জোরপূর্বক ভেকু মেশিন থেকে নামিয়ে মেশিনের চাবি কেড়ে নেয় এবং বাঁশের লাঠি দিয়ে সজোরে আঘাত করে। এসময় তারা সংস্কার কাজ করতে দুই লাখ টাকা চাঁদাদাবি করে, না দিলে মারধোরসহ ভেকু মেশিন পুড়িয়ে দেয়া হবে বলে হুমকি দেয়। এসময় জমির মালিকসহ সেখানে কর্মরত শ্রমিকরা তাদের বাধা নিষেধ করলে তাদের মধ্যে হাতাহাতির ঘটনা ঘটে এবং উভয় পক্ষের লোকজন আহত হয়। মারামারির খবর পেয়ে মোহনপুর থানা পুলিশ ঘটনাস্থল পৌছামাত্র সাবেক ছাত্রলীগ সভাপতি লিটন আলী ওরফে লিখন সেখানে উপস্থিত হন। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করে পুলিশ ঘটনাস্থল হতে আহতদের হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয় এবং লিখনকে থানায় নিয়ে আসে। পরে কয়েকজন রাজনৈতিক নেতা জলঘোলা করে জেলা ও উপজেলা প্রশাসনকে জানালে প্রথমে উপজেলা সহকারী কমিশনার ভূমি মিথিলা দাস পরে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আয়েশা সিদ্দিকা ও মোহনপুর থানা কর্মকর্তা ওসি হরিদাস মন্ডলকে সাথে নিয়ে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন এবং সেখান থেকে ভেকু ড্রাইভার মোঃ নাজমুল হক (২৩) ও হেলপার মোঃ জাফরুল হাসান (১৯)কে আটক করে থানায় সোপর্দ করেন। ঘটনাটি রাজনৈতিক জলঘোলা করে সংস্কার কাজ করতে চাঁদাদাবি করে জনতার হাতে আহত নাজমুল হোসাইন নামে একজন বাদি হয়ে লিটন আলী ওরফে লিখনসহ ভেকু ড্রাইভার ও হেলপারের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করলে পুলিশ তাদের জেল হাজতে প্রেরণ করে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে উপজেলা শ্রমিকলীগের সাধারণ সম্পাদক মিলন মাস্টারকে নিয়ে বিস্ফোরক মন্তব্য করেন মোহনপুর উপজেলার দ্বায়িত্বশীল এক আওয়ামী লীগ নেতা। তিনি বলেন, মিলন মাস্টার বিএনপির পরিবার থেকে উঠে আসা একজন শ্রমিকলীগ নেতা। তার পরিবারের কেউ আওয়ামী লীগ করতনা। তার ভাই ছিল ছাত্রদলের নেতা। মিলন মাস্টারের ছত্রছায়ায় বর্তমান সাংসদ জনপ্রিয় নেতা মোহা: আসাদুজ্জামান আসাদ ভাই ও দলের ভাবমূর্তি বিনষ্ট করতে সদর বাকশিমইল গ্রামের মৃত ছদেরের ছেলে চাঁদাবাজ ও সেলিমকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। সেলিম কাটাখালি পৌরসভায় আসাদ ভাইয়ের আওয়ামী লীগের প্রোগ্রামে মোহনপুর উপজেলা শ্রমিকলীগের সভাপতি মজিবর রহমান মাস্টারকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করে হুমকি ধামকি দিয়েছিল। এরপর দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আসাদ ভাইয়ের এর টিকেট কনফার্ম হলে জাহানাবাদ ইউপি চেয়ারম্যান হযরত আলীর কাছে ফোন করে চাঁদা দাবি করে সেলিম। বিষয়টি থানা পুলিশ পর্যন্ত গড়ালে মিলন মাস্টারসহ অন্যান্যরা তাকে বাঁচিয়ে নেয়।
এদিকে ঐ বিলে সংবাদকর্মীরা উপস্থিত হলে, মোহনপুর উপজেলার বাদেজুল গ্রামের অসংখ্য ভুক্তভোগী কৃষক বলেন "বুদ্ধি হওয়ার পর কোন দিন দেখিনি এখানে ফসল আবাদ হতে ! আমরা নিরুপায় ! আমরা বাধ্য হয়ে লিখন নামের একজনকে ১০ বছরের জন্য আমাদের জমি লীজ দিয়েছি। আপনারা আমাদের জমিকে বাঁচান ! আমরা অনেক ক্ষতিগ্রস্ত ! তাদের দাবি, আমাদের এলাকায় বাইরের কিছু লোক চাঁদা চাইতে আসলো, সেখানে পুকুরের লোকজনকেই মারধর করলো, আবার তাদেরকে না গ্রেফতার করে উল্টো পুকুর মালিককে গ্রেফতার করলো ? আমরা ভুক্তোভোগী, আমরাই পুলিশকে ফোন করেছি ! কার নির্দেশনায় এমন কাজ করেছে আমরা জানতে চাই ?
এ বিষয়ে মোহনপুর থানার অফিসার ইনচার্জ হরিদাস মন্ডল বলেন, সেখানে লিখন নামের একজন পুকুর খনন ও সংস্কার করছিল। অন্য একটি গ্রুপের সাথে খননকারিদের মারামারি হয়। খবর পেয়ে সেখানে দ্রুত পুলিশ উপস্থিত হয়। পরিস্থিতি শান্ত করে পুকুর খননকারি লিখন'কে আটক করা হয়। পরে আহতদের মধ্যে একজন বাদি হয়ে মামলা করলে, লিখন'কে গ্রেফতার দেখিয়ে জেল হাজতে পাঠানো হয়।
বিষয়টি নিয়ে মোহনপুর উপজেলার সহকারি কমিশনার (ভূমি) মিথিলা দাসের সাথে মুঠোফোনে কথা বললে তিনি জানান, ঘটনার পর আমি ও ইউএনও স্যার গিয়েছি। সেখানকার জমিতে কুচুড়িপানা রয়েছে । কিন্তু যেহেতু সেখানে কোন অনুমতি দেওয়া হয়নি, তাই এটি অবৈধ।