সারওয়ার জাহান
চাষের সময় আর খরচ দুটোই কম হওয়ায় কৃষকের কাছে বেশ জনপ্রিয় সরিষা চাষ। গত কয়েক বছর নতুন জাত উদ্ভাবনের ফলে শস্যাটির ফলন ও আগের চেয়ে বেড়েছে। এ কারণে দেশের বিভিন্ন স্থানের মতো গোমস্তাপুরের কৃষকদের মাঝে দিন দিন সরিষা চাষে আগ্রহ বাড়ছে। বাজারে দাম ভালো থাকায় গোমস্তাপুরের কৃষকরা সরিষায় আশার আলো দেখছে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুরে ফসলের মাঠগুলো ছেয়ে গেছে যেন হলুদ চাদরে। ফসলের মাঠের পূর্ব-পশ্চিম, উত্তর-দক্ষিণ যেদিকে তাকাই শুধু দু-চোখে হলুদ আর হলুদ ফুলের সমারোহ দেখা যায়। বিভিন্ন মাঠে মাঠে সরিষা ফুল প্রকৃতি প্রেমীদের মুগ্ধ করেছে। ষড়ঋতুর এই দেশে শীতকালের অগ্রহায়ণ মাস আসলেই ফসলের মাঠ যেন হলুদে হলুদে ছেয়ে যায়।
এমন নয়নাভিরাম সরিষা ফুলের দৃশ্য দেখে দুচোখ ফিরিয়ে নেয়া কঠিন। অনেকেই এই সরিষা ফুলের মাঠে মৌমাছি চাষ করে ব্যাপক লাভবান হচ্ছে। তাই এ সময় মাঠে মাঠে সরিষা ফুলের পাঁপড়িগুলোতে মৌমাছির উপস্থিতি ব্যাপকভাবে লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এমন চিত্র চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর উপজেলার বিভিন্ন ফসলের মাঠের।
সরজমিনে উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়ন পরিদর্শন করে দেখা গিয়েছে অন্যান্য ফসলের চেয়ে বেশি দাম পাওয়ায় কৃষকরা সরিষা চাষে বেশি ঝুঁকেছে। কুয়াশা উপেক্ষা করে কৃষকরা সরিষার ক্ষেত পরিচর্যায় ব্যস্ত সময় পার করছে। উপজেলার বোয়ালিয়া ইউনিয়নের ঘাটনগর, আলমপুর, কাশিয়াবাড়ী, মহানন্দা নদীর পাড়, কাউয়াভাষা, গোরীপুর, কাশিয়াবাড়ী, গোমস্তাপুর ইউনিয়নের চকপুস্তম, নয়াদিয়ারী, রহনপুর ইউনিয়নের কাজীগ্রাম, আসানপুর, পুনর চাঁদপুর, ভাগলপুর ও পার্বতীপুর ইউনিয়নের দেওপুরা ও বড়দাদপুরে সরিষার ব্যাপক চাষবাদ হয়েছে। রহনপুর ইউনিয়নের ভাগলপুর মোজার সরিষা চাষ আব্দুল মান্নান এর সাথে কথা হলে তিনি জানান, আমি এবার প্রায় সাড়ে ৩ বিঘা জমিতে বারি সরিষা-১৪ জাতের সরিষা বপন করেছি।
কৃষি অফিসের সহযোগিতা ও আল্লাহর রহমতে এখন পর্যন্ত সরিষা গাছ খুব ভালো হয়েছে। গত বছরের তুলনায় এ বছর আশা করছি ভালো ফলন পাব। তিনি আরও বলেন, চলতি বছরে আগের বছর গুলোর চেয়ে সরিষার আবাদ তুলনামূলকভাবে অনেক ভালো হয়েছে। এখন বর্তমানে তেলের দাম অনেক বেশি হওয়ায় কৃষি অফিস চাষীদেরকে সরিষা চাষে উদ্বুদ্ধ করছে।
এছাড়াও কৃষকদের সুবিধার্থে বিভিন্ন ধরনের পরামর্শ, জৈব সার, প্রশিক্ষণ ও বীজ দিচ্ছে। একই মৌজার চাষী বাসেদ আলী জানান, আমি এবার ৩ বিঘা জমিতে বারি সরিষা-১৪ জাতের সরিষা বপন করেছি। সরিষাতে এবার কৃষি অফিসের সহযোগিতায় জৈব সার ব্যবহার করে সরিষার ফলন বেশি হবে এমনটাই আশা করছি। সরিষা চাষ করে একদিকে যেমন তেলের চাহিদা পূরণ হচ্ছে অন্যদিকে বেশ লাভবান হচ্ছি। বোয়ালিয়া ইউনিয়নের চাষী আইনুল আরেফিন রুবেল জানান, এবার আমি ৫ বিঘা জমিতে সরিষার চাষ করেছি। আগের থেকে এবার সরিষার গাছ খুব ভালো হয়েছে।
এবার ১ বিঘাতে ৪ হাজার থেকে ৫ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। আশা করছি বিঘা প্রতি ৬ থেকে ৭ মণ করে সরিষা পাব। সরিষা আবাদ করে তেলের চাহিদা পূরণের পাশাপাশি অন্যান্য চাহিদা পূরণ হচ্ছে। কয়েকজন কৃষকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এক বিঘা জমিতে সরিষা আবাতে (হাল, বীজ, সার) বাবদ খরচ হয় ৬ হাজার থেকে ৭ হাজার টাকা । এক বিঘা জমিতে ৭ থেকে ৮ মন সরিষা পাওয়া যায়। প্রতি মন দাম দাঁড়ায় ২ হাজার থেকে ৩ হাজার টাকা। আর প্রতি বিঘায় খরচ বাদে লাভের পাশাপাশি নিজেদের তেলের চাহিদা পূরণ হয়। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে কৃষকরা সময় মতো সরিষা ঘরে তুলতে পারবে। গোমস্তাপুর উপজেলার কৃষি কর্মকর্তা তানভীর আহমেদ সরকার জানান, ‘চলতি বছরে এ উপজেলায় ৬ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে সরিষা আবাদ হয়েছে। যা গত বছর ছিল ৪ হাজার ৭৯০ হেক্টর।
এবার ১ হাজার ৭১০ হেক্টর জমিতে সরিষা আবাদ বেশি হয়েছে। চলতি বছর সরিষা আবাদকৃত জাতের মধ্যে সর্বাধিক চাষ বৃদ্ধি পেয়েছে বারি সরিষা-১৪, এ বছরে ৬ হাজার ৯৫০ জন কৃষককে ৯২৬.৬৬ হেক্টর জমিতে সরিষা আবাদের জন্য সার ও বীজ বিতরণ করা হয়েছে। এছাড়াও বিভিন্ন প্রকল্প (সরিষা প্রদর্শনী ও ফলোআপ প্রদর্শনী) থেকে ৯২৬ বিঘা জমিতে সরিষা আবাদ হয়েছে।" প্রতি বছরই কৃষি অফিসের উদ্যোগে সরিষা চাষের জন্য কৃষককে পরামর্শ ও উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে।
অন্যদিকে আমন ও বোরোর মাঝখানে বাড়তি ফসল হিসেবে সরিষা চাষ হচ্ছে ফলে শস্য নিবিড়তা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ বছরও লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি সরিষা আবাদ বৃদ্ধি পেয়েছে। সঠিক সময়ে ও বেশি প্রণোদনা কর্মসূচি বাস্তবায়ন অন্যতম কারণ। এছাড়াও আধুনিক জাত সম্প্রসারণে বেশি ফলন প্রাপ্তি এবং ভোজ্য তেল হিসেবে সরিষা ধীরে ধীরে কৃষককে সরিষা আবাদের দিকে উদ্বুদ্ধ করছে।
আমরা আশা করছি এবারও সরিষা বাম্পার ফলন হবে। ফলে তেল জাতীয় ফসল আবাদ বৃদ্ধির মাধ্যমে ভোজ্য তেল আমদানি কমিয়ে আনার যে সরকারের প্রচেষ্টা রয়েছে, সেই প্রচেষ্টার এক সফল অংশীদার গোমস্তাপুর উপজেলা হতে যাচ্ছে।"