নিউজ ডেস্ক
শেখ হাসিনার বিতর্কিত তিন নির্বাচনের তিন খলনায়ক সিইসি এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছেন। পুলিশ-প্রশাসনসহ নির্বাচনসংশ্লিষ্ট কিছু কর্মকর্তার বিরুদ্ধে চাকরিচ্যুতিসহ কিছু দৃশ্যমান ব্যবস্থা নেওয়া হলেও ভোট ডাকাতির মূল তিন হোতাকে এখনো আইনের আওতায় আনা হয়নি।
তিন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিবউদ্দীন আহমেদ, কে এম নূরুল হুদা ও কাজী হাবিবুল আউয়াল রয়েছেন বহালতবিয়তে। ওই তিন কমিশনের সদস্যরাও রয়েছেন অধরা। অবশ্য দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) থেকে ২০১৮ সালের নির্বাচন নিয়ে তদন্তের কথা জানালেও এখনো চূড়ান্ত কিছু হয়নি।
বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন নিয়ে কম-বেশি অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। তবে সব অনিয়ম ও কারচুপিকে ছাড়িয়ে গেছে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার আমলে অনুষ্ঠিত সর্বশেষ তিনটি জাতীয় নির্বাচন। তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিল করে ক্ষমতাসীন শেখ হাসিনার অধীনে অনুষ্ঠিত এ নির্বাচনগুলো ছিল চরম বিতর্কিত। নানা কূটকৌশলে ভোট ডাকাতির মাধ্যমে তিনবারই ক্ষমতাসীন হয় আওয়ামী লীগ। এই ডাকাতির হোতা ছিলেন তিন প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ তাদের কমিশনের সদস্যরা। একতরফা ও ‘বিনা ভোটের’ দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় প্রধান নির্বাচন কমিশনারের দায়িত্বে ছিলেন কাজী রকিবউদ্দীন আহমেদ। ‘নিশিরাতের ভোট’ হিসেবে পরিচিত একাদশ সংসদ নির্বাচনের সময় সিইসি ছিলেন কে এম নূরুল হুদা আর ‘ডামি নির্বাচন’ হিসেবে পরিচিতি পাওয়া দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের সময় সিইসি ছিলেন কাজী হাবিবুল আউয়াল।
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার আমলের গত সাড়ে ১৫ বছরের দুর্নীতি, অনিয়ম, ক্ষমতার অপব্যবহারসহ বিভিন্ন বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নিলেও যে তিনটি ‘ডাকাতির’ ভোটের মাধ্যমে শেখ হাসিনা ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করেছেন, তার হোতা এই তিন প্রধান নির্বাচন কমিশনারের বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ দেখা যায়নি। দুদক ২০১৮ সালের নির্বাচনে ভোট চুরি, অনিয়ম, প্রতারণা ও অর্থ আত্মসাৎ অনুসন্ধানের কথা বললেও জানা গেছে, কেবল ওই নির্বাচনের সময় সচিবের দায়িত্ব পালনকারী হেলালুদ্দীন আহমেদের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছে। সিইসি কিংবা অন্য কমিশনারদের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হয়েছে কি না, তা জানা যায়নি। অবশ্য দুদক জানিয়েছে, নির্বাচনসংশ্লিষ্ট সবকিছুর দুর্নীতির তদন্ত করবে তারা। এক্ষেত্রে ২০১৩ ও ২০২৪ সালের ভোটও তাদের তদন্তের আওতায় আসতে পারে বলে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে।
ওই তিন কমিশনে নির্বাচন কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন বেগম রাশেদা সুলতানা, মো. আলমগীর, মো. আনিছুর রহমান, মাহবুব তালুকদার, মো. রফিকুল ইসলাম, কবিতা খানম, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) শাহাদাত হোসেন চৌধুরী, মো. শাহ নেওয়াজ, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মো. জাবেদ আলী, মোহাম্মদ আবু হাফিজ ও মোহাম্মদ আবদুল মোবারক। এদের মধ্যে মাহবুব তালুকদার ২০২২ সালে মারা গেছেন। বাকি কমিশনারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়ে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। সাবেক এই তিন সিইসিসহ তাদের কমিশনের সদস্যদের প্রায় সবাইই এখন লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে গেছেন। এসব কমিশনারের কাউকে কাউকে আগে টকশোতে অংশগ্রহণসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে কথা বলতে দেখা গেলেও ৫ আগস্টের পর সেটা দেখা যাচ্ছে না।
নির্বাচনে অনিয়ম ও মামলার বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। আমার দেশ-এর প্রশ্ন শোনার পর তিনি ‘এ ব্যাপারে কিছু বলতে চাই না’ বলে ফোন কেটে দেন। আনিসুজ্জামানের নেতৃত্বাধীন বিডিআর তদন্ত কমিটির সদস্য হিসেবেও তার নামে বদনাম রয়েছে। অপরদিকে সাবেক সিইসি কাজী রকিবউদ্দীন আহমেদ ও কেএম নূরুল হুদার মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া গেছে।নূরুল হুদা কমিশনের সদস্য মো. রফিকুল ইসলাম বিষয়টি নিয়ে আমার দেশকে তার অবস্থান ব্যাখ্যা করেন। তিনি বলেন, সংস্কার কমিশন সুপারিশ করেছে এটা জেনেছি। এ বিষয়ে সরকার যেটা সিদ্ধান্ত নেয় সেটাই করবে। এই এখতিয়ার সরকারের রয়েছে। এ বিষয়ে আমার কোনো মন্তব্য নেই।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মামলা হয়েছে, কমিশন সুপারিশ করেছে। এ সুপারিশ সরকার কীভাবে দেখবে, এখানে আমার ব্যক্তিগত কোনো অবস্থান নেই। বিষয়টি নিয়ে আমার মন্তব্য করা উচিত হবে না। তবে মামলা বা তদন্তের বিষয়ে শতভাগ সহযোগিতা করতে প্রস্তুত বলে জানান সাবেক এই কমিশনার।
এদিকে তিনটি নির্বাচনের সময় নির্বাচন কমিশনের সচিবের দায়িত্ব পালন করেন যথাক্রমে ড. মুহম্মদ সাদিক, হেলালুদ্দীন আহমেদ ও জাহাঙ্গীর আলম। এদের মধ্যে জুলাই গণহত্যা মামলায় হেলালুদ্দীন আহমেদ ও জাহাঙ্গীর আলমকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ড. মুহম্মদ সাদিক ২০২৪ সালের ডামি ভোটে আওয়ামী লীগের টিকিটে এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন। বর্তমানে তিনি পলাতক।তিনটি নির্বাচনই বিতর্কিত হলেও অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত নির্বাচনি ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন ২০১৮ সালের নির্বাচনের দায় নিরূপণের জন্য একটি বিশেষ তদন্ত কমিশন গঠনের সুপারিশ করে নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন। জানা গেছে, ওই সুপারিশ বিবেচনা করেই দুদক ২০১৮ সালের ভোট তদন্ত করছে।
অন্য দুটি নির্বাচন তদন্তের সুপারিশ না করার কারণ ব্যাখ্যা করে কমিশনের প্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদার আমার দেশকে বলেন, তিনটি নির্বাচনের মধ্যে দুটি নির্বাচন ছিল সম্পূর্ণ একতরফা। অংশগ্রহণবিহীন ওই দুটি নির্বাচন প্রকৃত অর্থে নির্বাচনই ছিল না। কিন্তু ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দেশের মানুষ আশা করেছিল একটি অংশগ্রহণমূলক ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন হবে। কিন্তু আমাদের মনে হয়েছে ওই নির্বাচনে বেশি জালিয়াতি হয়েছে। এ কারণে আমরা এই জালিয়াতির নির্বাচন তদন্তে কমিশন গঠন করার সুপারিশ করেছি। তবে সরকার চাইলে দশম ও দ্বাদশ নির্বাচনে নির্বাচন কমিশনের দায় নিরূপণের জন্যও তদন্ত চালাতে পারে। কারণ ওই নির্বাচনেও সংশ্লিষ্ট নির্বাচন কমিশনাররা তাদের সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হন। তারা সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করতে পারেননি। এতে তাদের শপথ রক্ষা হয়নি। বিস্তারিত প্রতিবেদনে কমিশন ২০১৩ ও ২০২৪ সালের নির্বাচনের বিষয়েও তদন্তের কথা বলা হয়েছে বলে জানান সুজন সম্পাদক বদিউল আলম।
এর আগে গত ২২ নভেম্বর নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সঙ্গে গণমাধ্যমের সম্পাদকদের মতবিনিময়ে সাবেক তিন সিইসির নির্বাচনি অপরাধ নিয়ে আলোচনা হয়েছিল। বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের বদিউল আলম মজুমদার বলেন, তাদের বিরুদ্ধে কী ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া যায়, তা নিয়ে আলোচনা হলেও আমরা কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাইনি। পরে সংস্কার কমিশন কেবল ২০১৮ সালের নির্বাচন তদন্তের সুপারিশ করেছিল।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান আমার দেশকে বলেন, নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কারের বিষয়ে একটি সুপারিশ করা হয়েছে। নির্বাচন কমিশনের জাতীয় সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার পাশাপাশি তাদের বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। কেউই বিচারের ঊর্ধ্বে নন। কেউ উদ্দেশ্যমূলকভাবে অনিয়ম করলে বা দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে তারা দায় এড়াতে পারেন না।
তিনি বলেন, টিআইবি একটি গবেষণা পরিচালনা করেছে। সেখানে উঠে এসেছে সরকার দলের এজেন্ডা বাস্তবায়নে তারা ভূমিকা পালন করেছে। কাজেই বলব একটি ব্যবস্থা তাদের ক্ষেত্রে হওয়া উচিত। এজন্য ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশ পর্যন্ত অপেক্ষার বিষয় থাকতে পারে। আবার সরকার নির্বাহী আদেশে এ উদ্যোগ নিতে পারে।
বিনা ভোটের খলনায়ক সিইসি কাজী রকিব
২০১২ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি সিইসি হিসেবে নিয়োগ পেলে কাজী রকিবউদ্দীন আহমেদ শেখ হাসিনা সরকারের আজ্ঞাবাহী হয়ে কাজ করা শুরু করেন। দেশের নির্বাচনব্যবস্থাকে চরম বিতর্কিত করে ২০১৭ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি বিদায় নেন তিনি। এর আগে চারটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের যে সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল, রকিব কমিশন তা ধ্বংস করে দেয়। বিশেষ করে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির ভুয়া নির্বাচনটির কথা কারো অজানা নয়। ওই নির্বাচনে প্রধান বিরোধী দল অংশ নেয়নি। ভোটারবিহীন ওই নির্বাচনে ১৫৩ প্রার্থীকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী করা হয়। তার আমলে স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোও ছিল বিতর্কিত এবং ভোট ডাকাতি ও জালিয়াতিপূর্ণ। এসব কারণে তার নামের পাশে ‘খলনায়ক’ হিসেবে তকমা লাগে। কিন্তু তাতে তার অনুশোচনা দেখা যায়নি। বিদায়ী সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেছিলেন ‘বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়া দোষের কিছু নয়, আইনে আছে। আর কেউ মাঠ ছেড়ে দিলে তো প্রতিপক্ষ গোল দেবেই। এটা রাজনীতির খেলা। অর্থাৎ তিনি হাসিনা সরকারের পুতুল হিসেবে রাজনীতির খেলা খেলেছেন। সিইসি হিসেবে রাষ্ট্রের দায়িত্ব পালন করেননি।
রাতের ভোটের কারিগর সিইসি নূরুল হুদা
২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সিইসি হিসেবে যোগদান করে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পাঁচ বছরের দায়িত্ব শেষ করেন হাসিনা সরকারের আরেক আজ্ঞাবাহী সিইসি কে এম নূরুল হুদা। রকিব কমিশনের যোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে দেশের নির্বাচনি প্রক্রিয়ায় নির্বাচনব্যবস্থা ধ্বংসের শেষ পেরেকটি ঠুকে দেন তিনিই। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নৈশভোটের ঘৃণ্য নির্বাচনি প্রহসন এই ‘খলনায়ক’ সিইসির হাত ধরেই সংঘটিত হয়। কিন্তু বিদায়ী সংবাদ সম্মেলনে তিনি নির্লজ্জভাবে বলে যান, পাঁচ বছরে তার কমিশনের কাজ নিয়ে নাকি তিনি মোটেও ‘বিব্রত’ নন। তিনি নাকি সফলভাবেই জাতীয় নির্বাচনসহ ছয় হাজারের বেশি বিভিন্ন পর্যায়ের নির্বাচন করেছেন।
বিদায়ী সংবাদ সম্মেলনে কে এম নূরুল হুদা সফল কমিশন হিসেবে সর্বাধিক পরিচিত সাবেক সিইসি শামসুল হুদার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনেন যে, তার নেতৃত্বাধীন আগের কমিশন নাকি আর্থিক অনিয়ম করে গেছে। জরুরি সরকারের সময় শামসুল হুদা কমিশনের নেতৃত্বে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নির্বাচনটি হয়েছিল। ওই নির্বাচনও যে ‘ধোয়া তুলসীপাতা’ ছিল না, তার দিকে ইঙ্গিত করে কে এম নূরুল হুদা বলেন, ‘বন্দুকের নলের মুখে একবারই নির্বাচন করা যায়, বারবার নয়।’ অর্থাৎ নেপথ্যে ওই নির্বাচনেও যে জালিয়াতি হয়েছিল, সে কথাই বলেন তিনি। এটা ঠিক, তখন সেনা-সমর্থিত জরুরি সরকারের কুশীলবরা নির্বাচনে কলকাঠি নেড়েছিলেন।
আউয়াল কমিশনের যত বিতর্ক
কথিত অনুসন্ধান কমিটির সুপারিশে ২০২২ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি প্রধান নির্বাচন কমিশনার নিযুক্ত হন কাজী হাবিবুল আউয়াল। কাজী রকিব ও নূরুল হুদা কমিশনের ধারাবাহিকতায় একই পথে হাঁটেন কাজী হাবিবুল আউয়ালও। তবে তার পথ চলাটা ছিল ভিন্ন পদ্ধতিতে। কাজী রকিব যেখানে নেতৃত্ব দিয়েছেন ভোটারবিহীন নির্বাচনে, হুদার সময়টি ছিল নিশিরাতের ভোট। আর আউয়াল করেছেন ‘আমি-ডামি ভোট’। দায়িত্ব নেওয়ার পর আউয়াল কমিশন ব্যাপক তৎপরতা দেখাতে চাইলেও প্রথমে তারা হোঁচট খায়। কমিশন ইভিএম ও নির্বাচন প্রশ্নে সংলাপের ডাক দিলে তাতে খুব একটা সাড়া মেলেনি। ওই কমিশনের প্রতিটি সংলাপেই আমন্ত্রিত অতিথিদের প্রায় অর্ধেকই ছিলেন অনুপস্থিত। রাজনৈতিক দলের সংলাপে ৩৯টির মধ্যে বিএনপিসহ ৯টি দল অংশ নেয়নি। নির্বাচনের আগে অনুষ্ঠিত প্রস্তুতি সভাও বর্জন করেছিল নিবন্ধিত ৪৪টি দলের মধ্যে ১৮টি। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল ২৮টি দল, যার বেশিরভাগই ছিল নামসর্বস্ব ও সরকারের আজ্ঞাবহ।
ওই নির্বাচনে ভোটের হার নিয়ে বড় ধরনের বিতর্ক তৈরি হয়। ভোটের দিন বেলা ৩টা পর্যন্ত ২৭ দশমিক ১৫ ভাগ ভোট পড়ে বলে জানানো হলেও এক ঘণ্টার ব্যবধানে ভোটের হার ৪০ শতাংশ বলে উল্লেখ করা হয়। অবশ্য ভোটের হার ঘোষণার সময় সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল প্রথমে ২৮ শতাংশ ভোট পড়ার কথা বলে পরে তা সংশোধন করে ৪০ শতাংশের কথা বলেন। তার পাশে অবস্থান করা ইসি সচিব জাহাঙ্গীর কানে কানে বিষয়টি বলে দিলে সিইসি সংশোধন করেন। পরে তা নিয়ে নানা বিতর্ক তৈরি হয়।
এদিকে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর চুপসে যায় আউয়াল কমিশন। নতুন সরকারের সঙ্গে সাক্ষাতের চেষ্টা করে তারা কোনো সাড়া পায়নি। পরে গণমাধ্যমে একটি খোলা চিঠি লেখেন সিইসি হাবিবুল আউয়াল। তাতেও সাড়া না মিললে ৫ সেপ্টেম্বর সিইসিসহ অন্য কমিশনাররা পদত্যাগ করেন। এরপর থেকে হাবিবুল আউয়াল লোকচক্ষুর অন্তরালে অবস্থান করছেন।
কেমন ছিল বিতর্কিত তিন নির্বাচন
বিতর্কিত তিনটি সংসদ নির্বাচনের মধ্যে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো বর্জন করে। ওই নির্বাচনে নজিরবিহীনভাবে ১৫৩টি আসনে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ও তাদের জোটভুক্ত দলগুলোর প্রার্থীরা বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। নির্বাচন কমিশনের হিসাব অনুসারে ওই নির্বাচনে ৯ কোটি ১৯ লাখ ৬৫ হাজার ১৬৭ ভোটারের মধ্যে ১৫৩ আসনে চার কোটি ৮০ লাখ ২১ হাজার ৯৮৩ ভোটারের ভোট দেওয়ার সুযোগই ছিল না। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ও ফ্যাসিস্ট প্রধানমন্ত্রীও ভোট দেওয়ার সুযোগ পাননি। বাকি ১৪৭ আসনের চার কোটি ৩৯ লাখ ৪৩ হাজার ১৮৪ ভোটারের মধ্যে ৬০ শতাংশ ভোটার ভোট দেওয়া থেকে বিরত থাকেন।
২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনও বিরোধী দলগুলো বর্জন করায় ওই নির্বাচনে মূলত প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয় আওয়ামী লীগ ও নিজ দলের স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মধ্যে। একপক্ষীয় ওই নির্বাচনও অনিয়মের অভিযোগমুক্ত ছিল না। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হলেও বিরোধী দলগুলোর নেতাকর্মীদের ওপর ব্যাপক হামলা-মামলাসহ নানা অনিয়ম ও ভোট জালিয়াতির ঘটনা ঘটে। এ ছাড়া নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ ওঠে। ওই নির্বাচনে ভোটের আগের রাতেই বেশিরভাগ কেন্দ্রে জাল ভোট দিয়ে ব্যালটবাক্স ভর্তি করা হয়। ভোটটি রাতের ভোট নামে সর্বাধিক পরিচিতি পায়। প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক না হওয়ায় নির্বাচনের ফলাফলও হয় প্রায় একতরফা। নির্বাচনে ২৯৯টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট পায় ২৮৮টি আসন। অপরদিকে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট পায় মাত্র আটটি আসন।ওই নির্বাচনে ২১৩টি কেন্দ্রে শতভাগ এবং এক হাজার ৪১৮টি কেন্দ্রে ৯৬ শতাংশের বেশি ভোট পড়ে, যা অস্বাভাবিক। ৭৫টি আসনের ৫৮৭টি কেন্দ্রের সব বৈধ ভোট শুধু একজন করে প্রার্থী পান। অন্য কোনো প্রার্থী একটি ভোটও পাননি। ওই ৫৮৭টি কেন্দ্রের মধ্যে ৫৮৬টিতে (৯৯.৮৩ শতাংশ) সব ভোট পান নৌকা প্রতীকের প্রার্থীরা।একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে টিআইবির এক গবেষণায় বলা হয়েছে গবেষণাভুক্ত ৫০টি আসনের মধ্যে ৩৬টিতে বিরোধী দলের প্রচারে বাধাদানসহ ৪৪টি আসনে সরকারবিরোধী দলের প্রার্থীদের মনোনয়ন চূড়ান্ত হওয়ার পর থেকেই দলীয় নেতাকর্মীদের নামে মামলা, পুলিশ বা প্রশাসনের হুমকি ও হয়রানি, প্রার্থী এবং নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার ও ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী এবং কর্মীর দ্বারা বিভিন্ন সময় ভয়ভীতি দেখানো হয়। ৫০টির মধ্যে ৪১টি আসনে জাল ভোট, ৪২টি আসনে প্রশাসন ও আইন প্রয়োগকারী বাহিনীর নীরব ভূমিকা, ৩৩টি আসনে নির্বাচনের আগের রাতে ব্যালটে সিল, ২১টি আসনে আগ্রহী ভোটারদের হুমকি দিয়ে তাড়ানো বা কেন্দ্রে প্রবেশে বাধা, ৩০টি আসনে বুথ দখল করে প্রকাশ্যে সিল মেরে জাল ভোট দেওয়া, ২৬টি আসনে ভোটারদের জোর করে নির্দিষ্ট প্রতীকে ভোট দিতে বাধ্য করা, ২০টিতে ভোটগ্রহণ শুরু হওয়ার আগেই ব্যালটবাক্স ভরে রাখা, ২২টিতে ব্যালট পেপার শেষ হয়ে যাওয়া, ২৯টিতে প্রতিপক্ষের পোলিং এজেন্টকে কেন্দ্রে প্রবেশ করতে না দেওয়ার ঘটনা ঘটে।
সাবেক তিন সিইসির বিরুদ্ধে মামলা
গত বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামের একটি আদালতে সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী রকিবউদ্দীন আহদেদ, কে এম নূরুল হুদা ও কাজী হাবিবুল আউয়ালের বিরুদ্ধে প্রতারণা ও রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে মামলা হয়। ওই মামলায় তিন কমিশনের সব কমিশনার, নির্বাচন কমিশন সচিব হেলালুদ্দীন আহমেদ ও জাহাঙ্গীর আলম এবং তিনটি নির্বাচনে নির্বাচিত এমপিদেরও আসামি করা হয়। এ ছাড়া নির্দেশদাতা হিসেবে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরকে আসামি করা হয়।মামলার অভিযোগে বলা হয়, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে ও আসামিরা পরস্পর যোগসাজশে জনগণের সব গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ, দেশের সংবিধান ও আইন লঙ্ঘন করে একপেশে, জনগণের অংশগ্রহণবিহীন ভুয়া নির্বাচনের মাধ্যমে কিছু অনির্বাচিত লোককে সংসদ সদস্য ঘোষণা করে।
অভিযোগে আরো বলা হয়, দেশের মানুষ ভোট দিতে না পেরে নির্বাচনবিমুখ হয়ে পড়ে। বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে গণতন্ত্র। দেশে স্বৈরাচারী লুটেরা ব্যবস্থার আবির্ভাব হয়। দেশের সব সম্পদ বিদেশে পাচার করে দেশের অর্থনীতি পঙ্গু করে দেওয়া হয়।