নিউজ ডেস্ক
শিল্পপতি জসিম উদ্দিন মাসুমকে (৫৯) হত্যার ঘটনায় আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন অভিযুক্ত রুমা আক্তার (২৮) ও তার সহযোগী বান্ধবী রোকসানা ওরফে রুকু (২৬)।
শুক্রবার (১৫ নভেম্বর) দুপুর ও বিকেলে নারায়ণগঞ্জের সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট হায়দার আলীর আদালত পর্যায়ক্রমে তাদের জবানবন্দি গ্রহণ করেন।
নারায়ণগঞ্জ কোর্ট পুলিশের পরিদর্শক কাইউম খান আদালতে আসামিদের স্বীকারোক্তি প্রদানের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
নিহত শিল্পপতি জসিম উদ্দিন মাসুম নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার সস্তাপুর এলাকার মরহুম হাজী আলেক চান বেপারীর ছেলে। তিনি রাজধানীর একটি আবাসিক এলাকায় পরিবার নিয়ে থাকতেন। নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার চাঁদ ডায়িং ফ্যাক্টরিসহ বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের মালিক তিনি।
আদালতে জবানবন্দি দেয়া রুমা আক্তার ময়মনসিংহের গৌরিপুরের তাতরাকান্দা গ্রামের নজর আলীর মেয়ে। আর তার বান্ধবী রোকসানা ওরফে রুকু ঠাকুরগাঁওয়ের রুহিয়ার কানিকশালগাঁও গ্রামের মরহুম আবদুল হকের মেয়ে। জবানবন্দি দেয়া দু’জনই ঢাকার শেওড়াপাড়া এলাকার ডা. হাবিবুল্লাহর বাড়ির ভাড়াটিয়া ছিলেন।
নারায়ণগঞ্জ কোর্ট পুলিশের পরিদর্শক কাইউম খান বলেন, ‘আদালতে রুমা জানিয়েছে ১১ টুকরা করে শিল্পপতি জসিম উদ্দিন মাসুমকে হত্যা ও লাশ ফেলে দিতে রুমাকে সহায়তা করে তারই বান্ধবী মডেল রুকু। জবানবন্দিতে রুমা দাবি করেন, কাফরুলের তিনটি কক্ষের একটি ফ্ল্যাট নিয়ে তার ছোট বোন, বান্ধবী, ভাবী ও তার বাচ্চা বসবাস করেন। এ বাসায় আসার পর জসিম উদ্দিন মাসুমকে দুধের সাথে চেতনানাশক মিশিয়ে অজ্ঞান করা হয়। অচেতন অবস্থায় দু’ দিন থাকার পর মঙ্গলবার একটি কক্ষের বাথরুমে নিয়ে হত্যার পর লাশ ১১ টুকরা করা হয়। রুমার এক বন্ধুকে দিয়ে দু’টি ব্যাগ নিয়ে আসার পর দু’টি ব্যাগের ভেতরে সাত টুকরা রূপগঞ্জের একটি লেকের পাড়ে এবং অন্য চারটি অংশ ৩০০ ফিট এলাকায় ফেলে দেয় রুমা। এরপর বৃহস্পতিবার রুমার দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে কাশবন থেকে জসিম উদ্দিন মাসুমের দেহাংশের আরো চারটি টুকরা উদ্ধার করে পুলিশ। হত্যায় ব্যবহৃত চাপাতি, ব্লেড বনানীর ২০ নম্বর সড়কের একটি বাসায় রেখে আসেন রুমা। পরে ওই বাসায় অভিযান চালিয়ে চাপাতি, ব্লেড ও মাসুমের কিছু কাপড় জব্দ করা হয়েছে।’
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা রূপগঞ্জ থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) রোকনুজ্জামান বলেন, ‘গ্রেফতার হওয়া অভিযুক্তরা আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়ার ইচ্ছা পোষণ করলে শুক্রবার তাদের আদালতে আনা হয়। এরপর তারা আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। তবে তারা জবানবন্দিতে কি বলেছেন তা তার জানা নেই। জবানবন্দির কপি হাতে পেলে বলতে পারবেন। তদন্ত কর্মকর্তা আরো দাবি করেন, বিষয়টি অত্যন্ত স্পর্শকাতর। তদন্তে আরো অনেক কিছু জানার বাকি রয়েছে।’
এর আগে গত ১৩ নভেম্বর দুপুরে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার পূর্বাচল উপশহরের একটি লেক থেকে জসিম উদ্দিন মাসুমের খন্ডিত সাত টুকরা লাশ তিনটি পলিথিনে মোড়ানো অবস্থায় উদ্ধার করে পুলিশ।
পরদিন বিকেল ৩টায় সংবাদ সম্মেলনে নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) প্রত্যুষ কুমার মজুমদার বলেন, ‘গত ১০ নভেম্বর বিকেল থেকেই জসিম উদ্দিন নিখোঁজ ছিলেন। এ ঘটনায় নিহতের ছেলে ওবায়দুল ইসলাম শিবু রাজধানীর গুলশান থানায় তার নিখোঁজ হওয়ার একটি সাধারণ ডায়েরি করেন। গুলশান থানার ওই জিডির সূত্র ধরে আমরা এ ভুক্তভোগীর পরিচয় জানতে পারি।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তারা জানতে পেরেছেন, অবৈধ প্রেমের সম্পর্কের জেরে এ হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। গ্রেফতার হওয়া রুমার সাথে শিল্পপতি মাসুমের প্রেমের সম্পর্ক ছিল। এর পাশাপাশি এ শিল্পপতি মাসুম অন্য আরেক নারীর সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলেছেন। এ বিষয়টি জানতে পেরে রুমা রাগে-ক্ষোভে তাকে খুন করেন। গত ১০ নভেম্বর রাতে রাজধানীর শেওড়াপাড়া এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। মূলত সেখানে একটি ভাড়া বাড়িতে তারা একত্রিত হত। খুন করার আগে ওই নারী প্রথমে তাকে দুধের সাথে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে অচেতন করা ফেলেন। এরপর চাপাতি দিয়ে জবাই করে লাশ টুকরো টুকরো করা হয়। সেই টুকরো টুকরো অংশ প্রথমে পাঠাও এবং পরে সিএনজি ভাড়া করে বিভিন্ন স্থানে ফেলেন।’
তিনি আরো বলেন, ‘এ ঘটনায় রুমা আক্তারকে ঢাকার শেওড়াপাড়া এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয় এবং সন্দেহভাজন হিসেবে আরো দু’জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। আমরা লাশের টুকরো ও এ কাজে ব্যবহৃত একটি চাপাতি, একটি হ্যাকসো ব্লেড এবং ডিস্টিস্টের পরিহিত সাফারি, একজোড়া স্যু উদ্ধার করেছি। এ ঘটনায় রুপগঞ্জ থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে।’
তারও আগে জসিমের লাশ শনাক্ত হওয়ার পর নিহত ব্যক্তির ছেলে ওবায়দুল ইসলাম নারায়ণগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালের মর্গে ছুটে যান। সেখানে জসিমের ছেলে ওবায়দুল ইসলাম সাংবাদিকদের জানান, ‘গত রোববার বিকেলে তার বাবা ব্যক্তিগত গাড়িতে করে গুলশানের বাসা থেকে বের হন। পরে গুলশানে নিজের গাড়িটি ছেড়ে দেন এবং অন্য একটি গাড়ি নিয়ে নারায়ণগঞ্জে যাবেন বলে চালককে জানান।’
সেদিন রাত সাড়ে ১১টার দিকে তার বাবা জসিম মুঠোফোনে তার মায়ের সাথে কথা বলেন। তবে রাতে তিনি আর বাসায় ফেরেননি। পরদিন সকালে তার বাবার মোবাইল বন্ধ পাওয়া যায়। এ ঘটনায় তারা গুলশান থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। গত বুধবার রাতে খবর পেয়ে মর্গে এসে দাড়ি, নখ ও কিছু চিহ্ন দেখে তার বাবার লাশ শনাক্ত করেন।